নাঈমা, এক অল্পবয়সী মেয়ে, যার মুখে ছিল অগণিত কষ্টের ছাপ। কামলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের যাত্রীদের ব্যস্ততা আর কুলিদের কোলাহলের মধ্যে একা বসে অতীতের স্মৃতিচারন করছিলো ।
তার চোখের জ্বলজ্বলে অশ্রু, যেন মনের মধ্যে জমে থাকা এক পৃথিবী ভরী কষ্টের আড়াল।
নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে বাল্যবিবাহে বাধ্য করার জন্য নাঈমার মা নাঈমাকে মানসিক ভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। কখনো স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া কখনো রুমে আটকে রেখে শাস্তি দেয়া; কিছুই বাদ থাকতো না নাঈমার জন্য। পরিবার ও বাড়ি; সবকিছুই নাঈমার জন্য ছিল এক ধরনের আতঙ্কের মতো।
অবশেষে বাধ্য হয়ে সেই জীবন থেকে মুক্তি পেতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় নাঈমা। কিন্তু পথে জীবন ছিল কঠিন, আর অপরিচিত মানুষদের ভিড়ে মাসুদা হয়ে পড়ে আরও নিঃসঙ্গ।
আপন ফাউন্ডেশনের একজন সোশ্যাল মোবিলাইজার সেই স্টেশনে নাঈমাকে দেখতে পান। মলিন অবস্থা দেখে আগ্রহী হয়ে নাঈমার সাথে কথা বলতে শুরু করে। জানতে চায় স্কুলের সময়ে তার স্টেশনে বসে থাকার কারন। নাঈমা প্রথমে একটু সংকোচিত হলেও, ধীরে ধীরে তার মুখ খুলতে শুরু করে। সে বলতে থাকে কীভাবে তার জীবনে সবকিছু জোর করে পরিবর্তন করা হয়েছিল, এবং তার স্বাধীনতার স্বপ্ন কীভাবে ধীরে ধীরে চাপের কাছে হারিয়ে যাচ্ছিল। সে বলেছিল, “আমি যে জীবন চেয়েছিলাম, সেই জীবন পাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে বারবার আমাকে বাধা দেওয়া হয়েছে।”
তার পাশে বসে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে কথা বলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে নাঈমা তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করেন—কীভাবে সে নিজের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে, অথচ পরিবারে তা কখনোই স্বীকৃতি পায়নি। তার কষ্টের কথা শুনে, মোবিলাইজার তার পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং তার জন্য একটি নিরাপদ পথ খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি দেন।
এরপর, সোশ্যাল মোবিলাইজার নাঈমার বাবা ও কাজিনদের সাথে যোগাযোগ করেন। শিশুবিবাহের কুফল এবং এর অন্ধকার দিকগুলো তাদের সামনে তুলে ধরেন। এই আলোচনার মাধ্যমে, তারা বুঝতে পারে কেমন অন্যায়ের মুখোমুখি হয়েছে নাঈমা, এবং কেমন করে এই বিয়ে তার জীবনের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। ধীরে ধীরে নাঈমার পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে। তারা অনুভব করে যে নাঈমার সিদ্ধান্ত ছিল সাহসী, আর তার জীবন নিয়ে তাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত ছিল।
নাঈমার বাবা ও কাজিন সোশ্যাল মবিলাইজার, মুসলিম চ্যারিটি এবং আপন ফাউন্ডেশনের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং নাঈমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা প্রতিশ্রুতি দেয়, এবার থেকে তার স্বাধীনতাকে সম্মান করবে এবং তার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে নিজের পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ দেবে।
নাঈমার এই ঘরে ফেরা ছিল অশ্রু এবং অনুভূতির মিলন, একটি পরিবর্তনের গল্প। তার সাহস এবং আপন ফাউন্ডেশন ও মুসলিম চ্যারিটির সহযোগিতায়, নাঈমা শুধু তার পরিবার নয়, নিজের জীবনের স্বাধীনতাও ফিরে পেল।এই গল্পটি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠল, যা দেখিয়ে দিল—সহানুভূতি, বোঝাপড়া আর সমর্থনের মাধ্যমে জীবন নতুন করে শুরু করা সম্ভব।
এটি কেবল একটি শিশুকে ফিরিয়ে দেওয়ার গল্প নয়, বরং একটি পরিবারকে পুনরায় একত্রিত করার এবং একটি শিশুকে সম্ভাবনার নতুন জীবন উপহার দেওয়ার উদাহরণ। সমাজের জন্য এই ধরনের উদ্যোগ একটি আলো, যা শিশুদের নিরাপদ ভবিষ্যতের আশ্বাস দেয়।
অনুলেখক: সুরাইয়া ইসলাম, ইষ্ট ওয়েষ্ট ইউনিভার্সিটি।
যোগাযোগ: [email protected]