মধ্যাহ্ন ভোজের পর যখনই অফিসের সবাই রিল্যাক্স এ ডেস্কে ফিরে যাচ্ছে; তখনই হঠাৎ রেসকিউ নম্বরের ফোন বেজে উঠলো। ” বিমান বন্দর রেলওয়ে থানা থেকে বলছি; আপন ফাউন্ডেশন?” সোশ্যাল মবিলাইজারদের একজন ফোন ধরে “হ্যা” বলতেই সাথে সাথে বলা হলো; দ্রুত থানায় চলে আসুন; নাম পরিচয়হীন দু’জন মেয়ে কে খুজে পেয়েছি; দ্রুত এসে ওদেরকে নিয়ে যান !
সাথে সাথেই জিডি লেখার ফর্ম, শিশু হস্তান্তর ফর্ম, আইডি কার্ড সহ নানাবিধ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে থানার উদ্দেশ্যে। থানায় গিয়ে সোশাল মবিলাইজাররা দেখলো; সাইমা (ছদ্মনাম) ও নাইমা (ছদ্মনাম) চুপচাপ বসে আছে। প্রাথমিক কথা বলে জানা গেলো; ওরা খালাতো বোন। প্রাথমিক কাজ শেষ করে দুইজনকে নিয়ে আসা হলো আপন ফাউন্ডেশন এর শেল্টারে। সারা দিন বাহিরে থাকায় তাদের কাপড় ধুলামলিন, চোখে মুখে ক্লান্তি, মায়াভরা মুখ দেখলেই বোঝা যায় খুব আতংক, ভয় ও কষ্টে তাদের দিনটি কেটেছে। শেল্টারে আসা মাত্রই ফ্রেশ হয়ে খেয়ে পোশাক পরিবতর্ন করে অথই ঘুমে তলিয়ে গেলো বোনদুটি।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতেই একটু ধাতস্থ হলো দুই বোন। হাউজ সিসটারের সাথে নাস্তা করে শুরু হলো নতুন বসবাসের শেল্টারটি ঘুরে দেখা। এরপর শুরু হলো গল্প। গল্পের ছলে জানা গেলো বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা, এক রাত স্টেশনে থাকা এবং কন্যাশিশুর প্রতি সমাজের চাহুনীর গল্প।
সাইমা ও নাইমা একান্নবর্তী পরিবারের সন্তান। ওদের সাইমা থাকে তার মা-বাবা ও আরো ২ ভাই সহ এক পরিবারে। অপরদিকে নাইমা এর মা থাকে ঢাকায়। তিনি গার্মেন্টেসে চাকরী করেন। খালার সাথে থাকে নাইমা। দুইজনই নিকটবর্তী স্কুলে পড়াশুনা করে।
সাইমার বড়ো ভাই আছে যে বাবার সাথে মাঠের কাজ করে। আর ছোটো ভাইটা একদমই ছোটো। মাত্র দেড় বছর বয়স। পরিবারে সায়মার দায়িত্বই হলো ছোটো ভাইটাকে দেখা। অভাবের সংসারে মা কাজ করে অন্য বাসায়। ফলে পড়াশোনা তো হয়-ই না; উল্টো কখনো কখনো ছোটো ভাই কান্নাকাটি করলে সেটার খেসারত দিতে হয় সাইমাকে। বাবা, ভাই ও মা- তিনজন ই সাইমার উপর খড়গহস্ত হয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে সেটা এমন পরযায়ে চলে যেতো যা ছিলো অসহনীয়।
ভাই যখন সুযোগ পেতো তখনই মার-ধোর করতো। এদিকে ছোটো ভাই কান্না করলেই মা চলে আসতেন অপরাধের শাস্তি দিতে। কখনো লাকড়ি, কখনো খুন্তি বা কখনো হাতের কাছে যা পেতেন; তাই হয়ে যেতো শাস্তি দেবার মাধ্যম। এমনকি সাইমার শেষ আশ্রয়স্থল তার বাবার থেকেও মিলতো না কোনো সহযোগীতা। বাবা সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর বাবার কান ভারি করতো মা ও ভাই। ফলে বাবার হাতের চড় ও থাপ্পড় ছিলো অবধারিত। দিনে দিনে নিজের পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে সাইমা তার নিজেকে আবিস্কার করে এই ঘরের এক অবাঞ্চিত ব্যক্তি হিসেবে যার উপর সবাই সবার ক্ষোভ মিটাবে। তাই সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় এই বাসা থেকে বের হয়ে যাবে।
নাইমা এর গল্পও খুব সাইমা থেকে ব্যতিক্রম নয়। মা না থাকা এক মেয়ের জন্য নিজের ঘর-ও যে নিরাপদ নয় সে গল্পই আরেকবার শোনা হলো নাইমার কাছ থেকে।
এই ফাকে হাউজ ব্রাদাররা কাজে লেগে গেলো ওদের তথ্য মোতাবেক ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করতে, বাবা-মা এর সাথে কথা বলতে। দিনের শেষে সাইমা ও নাইমা উভয়ের বাবা-মা ই এলেন আপন ফাউন্ডেশন এর অফিসে। দুইদিন ঘরে না থাকায় তারা বুঝতে পেরেছেন তাদের মেয়ে ঘরের কাজের জন্যই নয়; তাদের রক্তও। কন্যা শোক সহ্য করতে পারেন নি সাইমার বাবা ও নাইমার মা। তারা আপন ফাউন্ডেশন অফিসে এসেও তাদের কান্না নিবারন করতে পারেন নি।
শিশু হস্তান্তরের সময় দুজনের বাবা – মা ই প্রতিজ্ঞা করলেন তারা এবার মেয়েদের যথাযথ সন্মান দেবেন দেবেন যথাযথ মরযাদা। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেন আপন ফাউন্ডেশন এর; তাদেরকে তাদের মেয়ে খুজে হস্তান্তর করার জন্য।
আপন ফাউন্ডেশন এর প্রজেক্ট সমূহের মাঝে অন্যতম প্রজেক্ট হচ্ছে পথশিশু, এতিম বা হারিয়ে যাওয়া শিশুদের পুনর্বাসন করা। ২০১৭ সালে থেকে ডোনার সংস্থার সহায়তায় এ পরযন্ত প্রায় ১৪০০ এর বেশী শিশুকে তার পরিবারের কাছে ফেরত দিয়েছে অথবা সেইফ হোমে পুনর্বাসন করেছে।
আপন ফাউন্ডেশন এর ফেইসবুক পেইজ এবং ওয়েবসাইট এ গেলে পাবেন এই ধরনের আরো গল্প সমূহ। আপন ফাইন্ডেশন চেষ্টা করে যাচ্ছে সমাজের পথে থাকা এতিম ও দুস্থ শিশুদের উন্নয়নের কাজ করে যেতে। আপনিও এগিয়ে আসুন, আপনার পাশের এতিমের দায়িত্ব নিতে, সমাজটাকে এগিয়ে নিতে।